আগরতলা : “একতা না থাকলে থানসা নয়—আর একতাই থানসার মূল শক্তি।” বৃহস্পতিবার আগরতলার স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে অনুষ্ঠিত ওয়ান নর্থ ইস্ট থানসা রেলিতে এই বার্তাই প্রতিধ্বনিত হয়। তিপ্রা মথার উদ্যোগে আয়োজিত এই রেলি ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নেতৃত্ব অংশ গ্রহণ করেন।
রাজধানীতে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের । রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একাধিক বিশিষ্ট নেতার উপস্থিতিতে সমাবেশটি জমে ওঠে এবং গোটা অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের এক অভিনব নিদর্শন তৈরি হয়। এই রেলিকে কেন্দ্র করে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন— মথা সুপ্রিমো প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মা, রাজ্যের মন্ত্রী অনিমেষ দেববর্মা, টিটিএএডিসির একাধিক এমডিসি, মথা বিধায়করা, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড কে. সাংমা, মনিপুরের প্রাক্তন মন্ত্রী হেমচন্দ্র সিং, এনপিপি-র ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট জেম সাংমা, নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী মোলমো কিকন,দার্জিলিংয়ের নেতা অজয় এডওয়ার্ডস, আসামের ড্যানিয়েল লাংথাসা প্রমুখ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতিনিধিদের এই উপস্থিতি গোটা অনুষ্ঠানকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। মথা সুপ্রিমো প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মা তার বক্তব্যে বলেন— “অনেকেই বলেছিলেন ‘থানসা’ বলে কিছু হবে না।
আজকের এই সমাবেশই তাদের যোগ্য জবাব। আজ এখানে গোটা নর্থ ইস্ট একত্রিত হয়েছে—এটাই প্রকৃত থানসা।” তিনি আরও বলেন, উত্তর-পূর্বের উন্নয়ন, অধিকার, পরিচয় ও মর্যাদার জন্য একজোট হয়ে কাজ করাই আগামী দিনের লক্ষ্য। “যদি নর্থ ইস্ট এক হয়ে দাঁড়ায়, তবে উন্নয়নের দরজা আরও বড় করে খুলে যাবে।”প্রদ্যোত দেববর্মন অভিযোগ করেন, জাতীয় দলগুলো সহজেই আগরতলায় সভা–সমাবেশ করতে পারলেও তার দলকে শুরু থেকেই নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন,“৭ নভেম্বর এই সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমরা অপেক্ষা করেছি, আজ অনুমতি নিয়ে করছি। এই সফলতা এসেছে থানসা— ঐক্যের কারণে।”‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ দাবিকে ব্যঙ্গ করার প্রবণতা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রদ্যোত। তার কথায়,“অনেকে হাসে, কটাক্ষ করে। কিন্তু যত আঘাত পাব, ততই আমরা আরও শক্ত হয়ে ফিরব। আজ না হলে কাল, একদিন গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড আমরা আদায় করে নেব— যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য রাখি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, জাতীয় দলগুলো আঞ্চলিক দলগুলিকে দুর্বল করতে নিয়মিত নানা কৌশল নেয়। দিল্লিতে জাতীয় দলের নেতার সঙ্গে দেখা করতে মুখ্যমন্ত্রীরাও কখনও–কখনও দশ দিন অপেক্ষা করেন। এটাই হল সম্মান!বিভিন্ন রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা তাদের বক্তব্যে একতা, পারস্পরিক সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সংহতি ও যুবসমাজের উন্নয়নের বিষয়গুলিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বলেন— “নর্থ ইস্ট ভারতের মডেল রিজিয়ন হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
একতার ভিত্তিতেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।” নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী মোলমো কিকন বলেন—“উত্তর-পূর্বের প্রতিটি সমাজ, উপজাতি ও ভাষার মানুষের সমস্যা আলাদা হলেও লক্ষ্য এক—একটি শক্তিশালী এবং সম্মানজনক ভবিষ্যৎ। তাই থানসা বা ঐক্যই হতে হবে মূল ভিত্তি।”
মনিপুরের প্রাক্তন মন্ত্রী হেমচন্দ্র সিং বলেন—“উত্তর-পূর্বের অশান্ত পরিবেশ, অবহেলা এবং পিছিয়ে পড়া দূর করার একমাত্র উপায়—সংহতি ও যৌথ আন্দোলন।”তিপ্রা, মিজো, গারো, কার্বি, নাগা, দিমাসা, রাবা সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপস্থিতি স্পষ্ট করে যে থানসা শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ।
মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বলেন, উত্তর–পূর্বের বিভিন্ন পাহাড় থেকে আসলেও সকলের পরিচয় একই— আদিবাসী বা স্বদেশী পরিচয়। “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা অভ্যন্তরীণ বিভাজন। ঐক্য না থাকায় আমরা আমাদের শক্তি দেখাতে পারিনি। তিনি বৈষম্য–বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’-কে স্বদেশী কণ্ঠস্বর তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আখ্যা দেন। সাংমার বক্তব্যে প্রদ্যোতের প্রতি বিশেষ সৌহার্দ্য প্রকাশ পায়, যা অনেকের কাছে আগামী নির্বাচনে তিপ্রা মথার মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে প্রদ্যোতকে ইঙ্গিত করার বার্তা হিসেবেও ধরা পড়েছে।
ত্রিপুরার বনমন্ত্রী ও তিপ্রা মথার শীর্ষ নেতা আনিমেষ দেববর্মা বলেন, জাতীয় দলগুলো আঞ্চলিক দলগুলোকে কেবল ‘অস্থায়ী ফুট সোলজার’ হিসেবে দেখে। বোডোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল নির্বাচনের উদাহরণ তুলে তিনি অভিযোগ করেন— জাতীয় দল আগে এক আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটে লড়েছিল, পরে জেতা দলের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে আগের জোটসঙ্গীকে বাদ দিয়েছিল।
রেলিকে কেন্দ্র করে আগরতলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মথা সমর্থকেরা সকাল থেকেই দলে দলে এসে ভিড় জমান। স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানের পুরো এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দলও নিয়োজিত ছিল। অনুষ্ঠানের শেষে একতা, সম্মিলিত উন্নয়ন এবং উত্তর-পূর্বের মানুষের অধিকার সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়ে সমাবেশের পর্ব শেষ হয়।
তিপ্রা মথা এখনও ত্রিপুরায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে থাকলেও এই সমাবেশের পর রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন— আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তিপ্রা মথা হয়তো একক ভাবেই লড়বে এবং ‘ওয়ান নর্থ ইস্ট’কে পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মের রূপ দিতে।
