গুয়াহাটি।।উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় সভা—উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শক্তি কমিটির ২৯তম বৈঠক শুক্রবার গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাতেই রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতন লাল নাথ তাঁর দৃঢ়, তথ্যভিত্তিক ও সুপরিকল্পিত বক্তব্যের মাধ্যমে শুধু ত্রিপুরাকেই নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিকে এক বড় আর্থিক বোঝা থেকে মুক্ত করলেন। এর আগের দিন টেকনিক্যাল কমিটির সভায় ওটিপিসি পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসে। এটি কার্যকর হলে শুধু ত্রিপুরা নয়, বরং পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভোক্তাদের উপর পড়ত বিশাল আর্থিক চাপ।

কিন্তু বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতন লাল নাথ সোজাসুজি সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেন, এটি শুধুমাত্র অযৌক্তিক নয়, বরং জনস্বার্থবিরোধী। কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপবে, যা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর বলিষ্ঠ অবস্থানের ফলেই প্রস্তাবটি বাতিল করতে বাধ্য হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শক্তি কমিটি।একই সভায়, সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন প্রতিটি রাজ্যকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন থাকুক কিংবা না থাকুক, তারপরেও কিনে রাখার জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছে এর বিরুদ্ধে রতন লাল নাথ বলেন, এই বিদ্যুৎ কেনার জন্য অর্থ কোথা থেকে আসবে? তা লাগু করা হলে পরোক্ষে তা গ্রাহকের উপর চাপ বাড়াবে। অবিলম্বে এ জাতীয় প্রস্তাব বাতিল করার দাবি জানান তিনি।

তার যুক্তি সমৃদ্ধ বক্তব্যের ফলে এ প্রস্তাবও স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় কমিটি। এই দুটি পদক্ষেপ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ—কারণ এর ফলে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং বিদ্যুৎ ভোক্তাদের উপর অর্থনৈতিক চাপ পড়বে না। এই সভায় বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতন লাল নাথ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব উদয়ন সিনহা, রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক অধিকর্তা বিশ্বজিৎ বসু এবং বিদ্যুৎ পরিবহন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন দেববর্মন।

গুয়াহাটির সভায় মন্ত্রী রতন লাল নাথ ত্রিপুরার বিদ্যুৎ খাতের বিপুল সাফল্য ও ভবিষ্যতের রূপরেখা অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শুধু প্রকল্প নয়, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে আমরা আধুনিকীকরণ এবং স্থায়িত্বের দিকে এগোচ্ছি।তিনি জানান, রাজ্যে ইতিমধ্যেই ২৬ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। ৪৫,০০০ সৌর রাস্তার আলো, ৪৯০০ সৌর পাম্প, ২১৫টি সৌর মাইক্রোগ্রিড স্থাপিত হয়েছে। ৩ মেগাওয়াট ছাদ সৌর প্যানেল এবং ২ মেগাওয়াট অফ-গ্রিড সৌর ইউনিট চালু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সূর্য ঘর মুফত বিদ্যুৎ যোজনা’ প্রকল্পকে “ঐতিহাসিক” বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মডেল সৌর গ্রাম তৈরি এবং স্থানীয় সংস্থাগুলিকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে গ্রামের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় এক বিপ্লব এসেছে।মন্ত্রী নাথ আরও জানান, ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার NHPC-র পাম্পড পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্প ত্রিপুরায় বাস্তবায়নের পথে।

এতে দিনে উৎপাদিত সৌর বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করে রাতে ব্যবহারের জন্য তৈরি রাখা যাবে—যা দেশের নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।‘One Sun, One World, One Grid’ প্রকল্পের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মন্ত্রী জানান, ত্রিপুরা আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ আদান-প্রদানের লক্ষ্যে আন্তঃরাজ্য গ্রিডকে শক্তিশালী করা হচ্ছে।এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ২,২৭৫ কোটি টাকার চুক্তির উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান,রোখিয়া ও গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আধুনিকীকরণ। স্মার্ট মিটারিং। ভূগর্ভস্থ তার সংযোগ । আধুনিক ট্রান্সফরমার পরীক্ষাগার নির্মাণ এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। সঙ্গে রয়েছেRMU, সার্জ অ্যারেস্টর, ড্রোন নজরদারি এবং লাইভ লাইনে রক্ষণাবেক্ষণ।

এছাড়াও আগরতলা শহরজুড়ে ওভারহেড তারের বিকল্প হিসেবে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শুরু হয়েছে। ত্রিপুরার SLDC-কে ISO/IEC 27001:2013 সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে, যা বিদ্যুৎ সেক্টরে সাইবার নিরাপত্তায় নতুন মাইলফলক।গুয়াহাটির সভায় রতন লাল নাথের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন অন্যান্য রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রীরাও। তাঁর উপস্থাপনা ছিল তথ্যনিষ্ঠ, বাস্তবভিত্তিক এবং সমস্যা ও সমাধানের নিখুঁত বিশ্লেষণভিত্তিক। তিনি বলেন, ত্রিপুরা এখন এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে আমরা কেবল নিজের চাহিদা পূরণ করছি না, বরং রপ্তানির প্রস্তুতিও নিচ্ছি। বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।

গুয়াহাটির শক্তি বৈঠকে রতন লাল নাথ যে ধরনের নেতৃত্ব ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা উত্তর-পূর্বের রাজনীতি ও প্রশাসনে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে জনগণের প্রতিনিধি, তাঁর পরিকল্পনা হয়ে উঠেছে একটি রাজ্যের ভবিষ্যতের ভিত্তিপ্রস্তর।ত্রিপুরা আজ আর বিদ্যুৎ ঘাটতির রাজ্য নয়। বরং নবায়নযোগ্য শক্তিতে আত্মনির্ভর এবং ভবিষ্যত-প্রস্তুত রাজ্য হিসেবেই ত্রিপুরা জাতীয় মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করছে।

আর এই রূপান্তরের কান্ডারি নিঃসন্দেহে রতন লাল নাথ। গুয়াহাটির সভার দিনটি তাই শুধু বিদ্যুৎ খাতের জন্য নয়, ত্রিপুরার জন্য ইতিহাস হয়ে থাকল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *