আগরতলা :ত্রিপুরায় বর্ষা মানেই অঝোর বৃষ্টি, দমকা হাওয়া আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এই দুর্যোগ যেন বিদ্যুৎ পরিষেবার উপর কাল হয়ে না নেমে আসে, সে দিকেই এবার নজর কেন্দ্রীভূত করেছে ত্রিপুরা রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (TSECL)।

বুধবার আগরতলার প্রজ্ঞা ভবনে রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতন লাল নাথের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত হলো এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা ও প্রস্তুতি বৈঠক। এই বৈঠকে মন্ত্রী ছাড়াও বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে অংশ নেন রাজ্যের বিদ্যুৎ সচিব অভিষেক সিং। তিনি নিগমের আধিকারিক ও কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশ দেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব উদয়ন সিনহা, ত্রিপুরা রাজ্য বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা অধিকর্তা বিশ্বজিৎ বসু, অর্থ অধিকর্তা সর্বজিৎ সিং ডোগরা এবং রাজ্যের বিভিন্ন সার্কেল ও বিভাগের এডিশনাল জেনারেল ম্যানেজার, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও সিনিয়র ম্যানেজাররা।

পর্যালোচনা বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতন লাল নাথ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন—আগামী দুই মাস অর্থাৎ বর্ষার পুরো সময়কাল বিদ্যুৎ দপ্তরের সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধুমাত্র গুরুতর চিকিৎসাজনিত কারণ ব্যতীত অন্য কোনো ছুটি অনুমোদন করা হবে না। মন্ত্রী বলেন, “বিদ্যুৎ পরিষেবা বজায় রাখা এই মুহূর্তে আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। রাজ্যবাসীর কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়াই সরকারের অঙ্গীকার। সেই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরে কর্মীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধার কথা সরকার অবশ্যই বিবেচনা করবে।”বিদ্যুৎ সচিব অভিষেক সিং এদিন বৈঠকে প্রতিটি বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করেন এবং উপস্থিত আধিকারিকদের মতামত শোনেন। বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেন তিনি, যাতে বর্ষাকালে সম্ভাব্য যেকোনো বিপর্যয় আগে থেকেই প্রতিহত করা যায়। তাঁর কার্যকর উপস্থিতি ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৌশলী ও আধিকারিকরা দারুণভাবে উৎসাহিত হয়েছেন lবৈঠকে বিদ্যুৎ মন্ত্রী এবং সচিব দু’জনেই জোর দেন জঙ্গল কাটিং ও সাবস্টেশন-পরিবাহী লাইনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণের উপর। মন্ত্রী রতন লাল নাথ বলেন, “প্রতিবছর দেখা যায় গাছের ডাল পড়ে বিদ্যুৎ লাইনের উপর। এতে যেমন পরিষেবা ব্যাহত হয়, তেমনই বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। অথচ অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের গাছ কাটতে বাধা দেন।”এই বিষয়ে তিনি জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনারা সহযোগিতা করুন, বিদ্যুৎ নিগমকে কাজ করতে দিন। অপ্রয়োজনীয় বাধা না দিলে বিপদ অনেকটাই কমে যাবে।” এদিন বিদ্যুৎ পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তথ্য তুলে ধরেন নিগমের জেনারেল ম্যানেজার স্বপন দেববর্মা। ডেপুটি ও সিনিয়র ম্যানেজাররা তাদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ, প্রাক-বর্ষা মেরামতি, সাবস্টেশনের অবস্থা, ট্রান্সফরমার বদল ইত্যাদি বিষয়ে বিশদে তথ্য দেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, অধিকাংশ বিদ্যুৎ বিভাগের প্রাক-বর্ষা মেরামতির কাজ ইতিমধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। তা সত্ত্বেও কোনো এলাকায় সমস্যা থাকলে তা দ্রুত শেষ করতে বলা হয়।

বিদ্যুৎ নিগমের ব্যবস্থাপনা অধিকর্তা বিশ্বজিৎ বসু বৈঠকে স্পষ্ট জানান, “পরিষেবা যেন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত জনবল, গাড়ি বা যন্ত্রাংশ কোন কিছুর অভাব হবে না l প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আধিকারিকদের চট জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে বিদ্যুৎ নিগম বর্ষাকালীন বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে চূড়ান্তভাবে সচেষ্ট। ট্রান্সমিশন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন দেববর্মা বৈঠকে বলেন, রাজ্যের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ পরিবাহী লাইন এবং সাবস্টেশনের মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। তিনি জানান, “কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে যেখানে বিগত বছরে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল।”তিনি এ-ও বলেন, “সাবস্টেশনে কাজের জন্য মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হতে পারে, তবে সেটা জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে।”বৈঠকে বিদ্যুৎ মন্ত্রী বারবারই জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি বলেন, “জনগণের সহযোগিতা ছাড়া নিগম একা এই বিশাল কাজ সামলাতে পারবে না। গাছ কাটা, বৈদ্যুতিক লাইন সংস্কার বা সাবস্টেশন কাজ চলাকালীন কেউ যাতে অযথা বাধা না দেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।” বিদ্যুৎ বিল সময়মতো পরিশোধ এবং অবৈধ হুক লাইন বন্ধ করার জন্য সাধারণ মানুষের সহযোগিতাও চান মন্ত্রী। তিনি বলেন, “আপনারা সময়মতো বিল দিন, হুকলাইন বন্ধ করুন—তাহলেই বিদ্যুৎ পরিষেবা আরও স্থিতিশীল হবে।”মন্ত্রী বলেন, “গত দুর্গাপূজা ও ২০২৪ সালের বন্যার সময় আমাদের বিদ্যুৎ কর্মীরা যেভাবে কাজ করেছেন, সেটা অভাবনীয়। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার বর্ষাকালেও একইভাবে একযোগে লড়াই করতে হবে।” তিনি উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দীপিত করে বলেন, “আপনারা শুধু চাকরি করছেন না, জনগণের সেবায় নিয়োজিত। সেই ভাবনা নিয়েই কাজ করুন।”পর্যালোচনা সভার শেষে ধন্যবাদজ্ঞাপন করেন নিগমের অর্থ অধিকর্তা সর্বজিৎ সিং ডোগরা। তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ বিল আদায়, আর্থিক স্বচ্ছতা, এবং বাজেট অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি—এসবই আমাদের নজরদারির আওতায় থাকবে। সঠিক পরিকল্পনাই সফলতা এনে দেবে।”ত্রিপুরা রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমের বর্ষাকালীন এই উচ্চপর্যায়ের প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

মন্ত্রী রতন লাল নাথ ও সচিব অভিষেক সিং-এর নেতৃত্বে নিগমের আধিকারিকরা যে মনোযোগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, তা রাজ্যবাসীর জন্য আশাব্যঞ্জক। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পরিষেবা নিশ্চিতে এই প্রস্তুতি এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে প্রশাসনের একার চেষ্টায় সফলতা আসে না—জনগণের সচেতনতা, সহযোগিতা এবং দায়িত্ববোধই হতে পারে এই উদ্যোগের প্রকৃত শক্তি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *